ভাবসম্প্রসারণ দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য

আসসালামু আলাইকুম বন্ধুরা আজকে তোমাদের সামনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভাবসম্প্রসারণ নিয়ে হাজির হয়েছে। কে তোমাদের সাথে আমরা এই দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য ভাসম্প্রসারণটি তুলে ধরব। তাহলে চলো কথা না বাড়িয়ে শুরু করা যাক।

ভাবসম্প্রসারণ দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য

বাংলা প্রবাদ “দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য” একটি অতি পরিচিত ও প্রচলিত প্রবাদ। এর মূল অর্থ হলো, একজন খারাপ চরিত্রের ব্যক্তি যদি অত্যন্ত জ্ঞানী ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ হয়, তবুও তাকে এড়িয়ে চলাই শ্রেয়। কারণ তার দুর্নীতিপরায়ণতা বা খারাপ অভ্যাস তার জ্ঞানকে ছাপিয়ে যায় এবং সমাজের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। এই প্রবাদটি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত জীবনে নয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, এবং সাংস্কৃতিক জীবনের প্রতিটি স্তরে প্রযোজ্য। প্রবাদটির পেছনের যুক্তি ও প্রাসঙ্গিকতা আলোচনা করতে গেলে বিভিন্ন দিক থেকে এর সত্যতা অনুধাবন করা যায়।

প্রথমত, একজন ব্যক্তির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তার জ্ঞান এবং প্রতিভার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। যদি কেউ জ্ঞানী হয় কিন্তু তার আচরণ এবং মনোভাব দুর্নীতিপরায়ণ হয়, তবে তার জ্ঞান তার চরিত্রকে উন্নত করতে ব্যর্থ হয়। উদাহরণস্বরূপ, একজন দুর্নীতিগ্রস্ত শিক্ষক হয়তো জ্ঞান বিতরণে সক্ষম, কিন্তু তার খারাপ আচরণ শিক্ষার্থীদের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। শিক্ষার্থীরা তার দুর্নীতিপরায়ণতা থেকে শিখে একই ধরনের খারাপ আচরণ গড়ে তুলতে পারে, যা সমাজের ভবিষ্যত প্রজন্মের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।

দ্বিতীয়ত, একজন দুর্জনের বিদ্যা প্রায়শই তার নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহৃত হয়। দুর্জন ব্যক্তিরা প্রায়ই তাদের জ্ঞান ও প্রতিভা নিজেদের সুবিধার জন্য ব্যবহার করে, যা তাদের স্বার্থপর এবং ক্ষতিকর করে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, একজন প্রতারক আইনজীবী তার জ্ঞান ও কৌশল ব্যবহার করে আইনকে নিজের সুবিধার্থে ব্যবহার করতে পারে, যা ন্যায়বিচারকে ব্যাহত করে এবং সমাজে অনাচারের জন্ম দেয়। তাদের জ্ঞান ও প্রতিভা সমাজের উন্নতির জন্য নয় বরং সমাজের ক্ষতির জন্য ব্যবহৃত হয়, যা তাদের পরিত্যাগ করা অত্যন্ত জরুরি করে তোলে।

তৃতীয়ত, একজন দুর্জনের সঙ্গে যুক্ত থাকলে তার খারাপ প্রভাব আমাদের উপর পড়তে বাধ্য। আমরা প্রায়ই বলি “আপনি যার সঙ্গে মেলামেশা করেন, তার মতোই হয়ে যান।” একজন খারাপ চরিত্রের ব্যক্তির সঙ্গে সময় কাটালে, তার দুর্নীতি, প্রতারণা এবং অনৈতিকতা আমাদের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। এতে আমাদের চারিত্রিক গুণাবলী ধ্বংস হয়ে যেতে পারে এবং আমরা নিজেরাও দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে উঠতে পারি। এজন্যই একজন দুর্জনের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা প্রয়োজন।

রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এই প্রবাদের প্রাসঙ্গিকতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবিদ বা নেতারা, যাদের মধ্যে প্রায়শই উচ্চতর শিক্ষা এবং রাজনৈতিক জ্ঞান থাকে, তাদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দেশের সম্পদ ও জনতার বিশ্বাসকে অপব্যবহার করে থাকে। তারা ব্যক্তিগত স্বার্থে দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করে, যা দেশের জনগণের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এমন নেতারা তাদের বিদ্যার মাধ্যমে জনগণকে প্রতারণা করে এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে, যা সমাজে অন্যায় ও অবিচারের প্রসার ঘটায়। এজন্যই এমন দুর্জন নেতাদের পরিত্যাগ করা উচিত।

শিক্ষা ক্ষেত্রেও এই প্রবাদের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। একাডেমিক জীবনে কিছু শিক্ষক ও অধ্যাপক আছেন যারা জ্ঞানী ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ হলেও তাদের চরিত্রে দুর্নীতি ও অনৈতিকতা বিদ্যমান। তারা ছাত্রছাত্রীদের মাঝে জ্ঞানের আলো বিতরণ করতে সক্ষম হলেও তাদের দুর্নীতিপরায়ণ আচরণ শিক্ষার্থীদের মানসিক ও নৈতিক বিকাশে ক্ষতি সাধন করে। শিক্ষার্থীরা তাদের আদর্শ মেনে চলতে গিয়ে নৈতিকতা হারায় এবং ভবিষ্যতে দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে ওঠে। এজন্যই শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্জনদের পরিত্যাগ করা অপরিহার্য।

একইভাবে, সাহিত্য ও সংস্কৃতির জগতে এমন অনেক লেখক, শিল্পী ও সংস্কৃতিবিদ আছেন যারা অত্যন্ত প্রতিভাবান ও জ্ঞানী, কিন্তু তাদের চরিত্রে দুর্নীতি ও অনৈতিকতা বিদ্যমান। তাদের সৃষ্টিকর্ম প্রায়শই সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও তাদের ব্যক্তিগত জীবনের খারাপ দৃষ্টান্ত সমাজের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তারা তাদের প্রতিভার মাধ্যমে সমাজের একটি অংশকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হলেও তাদের দুর্নীতিপরায়ণতা ও খারাপ আচরণ সমাজের নৈতিক ভিত্তি দুর্বল করে দেয়।

এই প্রবাদের পেছনে আরেকটি দার্শনিক ধারণা রয়েছে, যা হল জ্ঞান এবং নৈতিকতার সংযোগ। প্রকৃত জ্ঞান শুধু বুদ্ধিমত্তা এবং তথ্যের অর্জন নয়, বরং নৈতিকতার উন্নয়নের মাধ্যমেও জড়িত। একজন সত্যিকারের বিদ্বান ব্যক্তি কেবলমাত্র তথ্য এবং তত্ত্ব জানেন না, তিনি তার জ্ঞানকে সঠিক ও নৈতিক উপায়ে প্রয়োগ করতে সক্ষম হন। এজন্যই প্রকৃত বিদ্বান এবং দুর্জনের মধ্যে পার্থক্য করা গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃত বিদ্বানরা সমাজের উন্নয়নে কাজ করেন, অপরদিকে দুর্জনেরা নিজেদের স্বার্থে জ্ঞানকে অপব্যবহার করেন।

আধুনিক যুগে, যেখানে তথ্য ও জ্ঞানের প্রবাহ অত্যন্ত দ্রুত, সেখানে এই প্রবাদের গুরুত্ব আরও বেড়েছে। প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিরাও তাদের কৌশল পরিবর্তন করেছে। তারা তাদের জ্ঞান ও প্রতিভা ব্যবহার করে নতুন নতুন পন্থায় সমাজের ক্ষতি করছে। সাইবার অপরাধ, অনলাইন প্রতারণা, ডাটা চুরি ইত্যাদি আধুনিক যুগের দুর্জনের কাজের উদাহরণ। এজন্যই এই যুগে দুর্জনের বিদ্যা পরিত্যাগ করার প্রয়োজনীয়তা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।

শেষমেশ, “দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য” প্রবাদটি একটি সময়োপযোগী এবং বাস্তবমুখী উপদেশ প্রদান করে। এটি আমাদের শেখায় যে একজন ব্যক্তির চারিত্রিক গুণাবলী এবং নৈতিকতা তার জ্ঞান এবং প্রতিভার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। একজন দুর্জন ব্যক্তি তার বিদ্যা ও প্রতিভা সত্ত্বেও সমাজের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, এবং এজন্যই তাকে পরিত্যাগ করা শ্রেয়। এই প্রবাদের মাধ্যমে আমরা আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং প্রফেশনাল জীবনে সঠিক এবং নৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *